২৩শে মার্চ ভূরুঙ্গামারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কুড়িগ্রাম মহকুমা ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ, আওয়ামীলীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, পুলিশ, আনসার-মুজাহিদ, সাবেক ইপিআর, আওয়ামীলীগ কর্মী, নেতা এবং সর্বস্তরের জনগণের এক বিরাট সমাবেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য শপথ গ্রহণ করা হয়। ঐ সমাবেশেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ভূরুঙ্গামারীর ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।
২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা শুরু হলে ২৬শে মার্চ জরুরী ভিত্তিতে স্থানীয় নেতাদের নিয়ে এক গোপন বৈঠকে থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং সমস্ত ইউনিয়নে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার জন্য জরুরী নির্দেশ প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ মোতাবেক সর্বস্তরের জনগণকে সংঘবদ্ধ করার জন্যও কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়।
ইতোমধ্যে ভূরুঙ্গামারী থানার সীমান্তবর্তী ফাড়িগুলোর সাবেক অবাঙ্গালী ইপিআর-রা সাবেক বাঙ্গালী ইপিআর-দের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। ইপিআর আনিস মোল্লা এবং রওশনুল বারীর নেতৃত্বে ইপিআররের সদস্যবৃন্দ আমাদের সহযোগিতা কামনা করলে স্থানীয় এক জরুরী বৈঠকে অবাঙ্গালী ইপিআরদের সক্রিয় সাহায্যের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
২৮শে মার্চ অবাঙ্গালী ইপিআরদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরদিন ২৯ মার্চ বাঙ্গালী ইপিআর এবং সম্মিলিত ছাত্র জনতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে জয়মনিরহাট ক্যাম্পের একজন অবাঙ্গালী সুবেদার, একজন ড্রাইভার এবং একজন অয়ারলেস অপারেটর নিহত হয়।উক্ত জয়মনিরহাট ক্যাম্পে অবাঙ্গালী ইপিআরদের সঙ্গে সহযোগিতাকারী জয়মনিরহাটের একজন অবাঙ্গালী চক্ষু চিকিৎসক জনগণের হাতে নিহত হয়।
অত্র থানার অন্যান্য সীমান্ত ফাঁড়ি যেমন- কেদার, সোনাহাট, ধলডাঙ্গা প্রভৃতি স্থানে বাঙ্গালী ইপিআরদের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েকজন অবাঙ্গালী ইপিআর নিহত হয়। অবাঙ্গালী ইপিআরদের কবল থেকে জয়মনিরহাট ক্যাম্প ও অস্ত্রাদি উদ্ধার করা হয় এবং নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী থানার সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআরগণকে তাদের অস্ত্রসমেত উক্ত ক্যাম্পে জরুরী ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ করা হয়।
অতঃপর সাবেক বাঙ্গালী ইপিআরগণের সঙ্গে আনসার, মুজাহিদ এবং আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী জয়মনিরহাটে যোগ দেয়। ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ও এখানে যোগ দেয়। এদের সকলকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিয়ে হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা হয়।
জয়মনিরহাটে সংঘবদ্ধ এই দলকে বিভিন্ন ক্যাম্পে এবং পুলিশ ফাঁড়ি থেকে প্রাপ্ত সামান্য অস্ত্র দিয়েই রংপুর সামরিক গ্যারিসন থেকে হানাদার বাহিনী যাতে অত্র অঞ্চলে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তিস্তাপুল প্রতিরোধ কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ২৯শে মার্চ শামছুল হক চৌধুরী ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে সোনাহাট এবং সাহেবগঞ্জ সীমান্ত ঘাঁটির সেনাধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের অনুরোধে উক্ত সেনাধ্যক্ষ প্রাথমিক বেসরকারী সাহায্য হিসেবে ১লা এপ্রিল মধ্যরাতে ২টি হাল্কা মেশিনগান, কিছুসংখ্যক রাইফেল এবং প্রচুর হাতবোমা প্রদান করেন। এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ তিস্তাপ্রতিরোধ কেন্দ্রে সরাসরি পাঠানো হয়। পরবর্তীতে সোনাহাট ও সাহেবগঞ্জের ভারতীয় সীমান্ত ঘাঁটি থেকে আরও সামরিক সাহায্য নেওয়া হয়।
৫ই এপ্রিল ভূরুঙ্গামারী কলেজে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। যুবক এবং ছাত্ররা এখানে প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। শ্রীঘ্রই বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল থেকে বহু ছাত্র-যুবক এখানে আসতে থাকলে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি সম্প্রসারণ করা হয়। সমগ্র রংপুর জেলার বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে বাঙ্গালী ইপিআরদেরকে ভূরুঙ্গামারী থানায় সংঘবদ্ধ করে দুই কোম্পানি ইপিআরকে তিস্তা প্রতিরোধ কেন্দ্রে পাঠান হয় এবং এক কোম্পানী ইপিআরকে ভূরুঙ্গামারীতে সংরক্ষিত রাখা হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ও প্রধান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসেবে ভূরুঙ্গামারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হানাদার কবলিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অসংখ্য গেরিলা যোদ্ধা তৈরি করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাথমিক ট্রেনিং দিয়েই গেরিলাদেরকে সরাসরি প্রতিরোধ ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তীকালে এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছে। সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে অত্র থানার বিভিন্ন ইউনিয়নের জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আর্থিক সাহায্য করেছেন। এছাড়া ভারতীয় জনগণ ভূরুঙ্গামারী থানার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে চাল, গম, আলু, কেরোসিন, পেট্রোল, বিস্কুট, কাপড়, ঔষধপত্র প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেছেন।
ভারতে প্রবেশের পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ করা হয়। ভারতের পশ্চিম বাংলা সীমান্তের সাহেবগঞ্জ ও আসামের সোনাহাটে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অনুমোদনে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়।এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা অধিকৃত ভূরুঙ্গামারী এবং নাগেশ্বরী থানার বিভিন্ন স্থানে হানাদারদের প্রতি আঘাত হানতে থাকে। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক অধিকৃত অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করার জন্য পশ্চিম বাংলা সীমান্তে যুবশিবির খোলার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় এই যুবশিবিরগুলো স্থানীয় ভারতীয় জনগনের আর্থিক সাহায্যপুষ্ট ছিল।পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার যুবশিবিরগুলোর আর্থিক দায়িত্ব গ্রহণ করে। যুবশিবিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং-এর পর তাদের উচ্চতর ট্রেনিং-এর জন্য ভারতের অভ্যন্তরে পাঠানো হতো।
দুধকুমার নদীর পূর্বতীরস্থ এবং ভূরুঙ্গামারী থানার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল হানাদারকবল মুক্ত ছিল। এই সমস্ত অঞ্চলের জনগণের সার্বিক সাহায্যের জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়েছি। মুক্তাঞ্চলের জনগণের নিরাপত্তার জন্য নাগেশ্বরী থানার সুবলপাড় বন্দরে এবং মাদারগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের সাবেক ইপিআর বাহিনীর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ-এর অধীনস্থ সাহেবগঞ্জ ঘাঁটির গেরিলাযোদ্ধা এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আসাম সীমান্তের সোনাহাট ঘাটির গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈন্যদের এক যৌথ অভিযানের পর ১৪ নভেম্বর ভূরুঙ্গামারী মুক্ত হয়। এর পরপরই অত্র থানার আন্ধারীঝাড় বাজার থেকে পাক বাহিনী তাদের গোলন্দাজ বাহিনী সরিয়ে পিছু হটে গেলে ভূরুঙ্গামারী থানা শত্রুমুক্ত হয়। এই এলাকা মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আশ্রিত জনগণ বিধ্বস্ত ভূরুঙ্গামারীতে দলে দলে প্রবেশ করতে থাকে। মাতৃর্ভুমিতে পা দিয়েই জনগণের আনন্দ-উল্লাস সবাইকে অভিভূত করে। ডিসেম্বরে সারা বাংলাদেশের মুক্তির সাথে সাথে জনগণ এক অভূতপূর্ব আনন্দে উল্লাসিত হয়েছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস